• ইউসুফ আরমান

জীবনের অপ্রত্যাশিত ও কাল্পনিকের মতো কাহিনী। কি আনন্দ আর কি বেদনা। কিছু মনের অনুভূতি আর কিছু চির অম্লান স্মৃতি। কিছু চাওয়া আর কিছু পাওয়া। জীবন চলছে জীবনের নিয়মে কোন সিগন্যাল ছাড়া। বিকল্প ভাবনা আর চিন্তাধারা। কিছু লেখা মনের বহিঃপ্রকাশ আর কিছু বলার অপপ্রয়াস।
অপরিকল্পিত অগ্রযাত্রা সৌদি আরবে। ভাইদের আবদার; তাদের খরচে ভ্রমণে যেতে হবে! অপ্রস্তুত আমি নির্বাক হয়ে কোন প্রতিক্রিয়া বিহীন ব্যাগ গোছানো শুরু। আলহামদুলিল্লাহ সব কিছু ঠিকঠাক বিমানের টিকেট হাতে পেলাম। ১৪-০২-২০২২ তারিখ সকাল ১০.১৫ চট্টগ্রাম বিমান বন্দর থেকে সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশ্যে আকাশে উড়াল দিলো। বেশ ভাল লাগছে যেহেতু আন্তর্জাতিক বিমানে প্রথম এবং জীবনের প্রথম দেশের বাইরে ভ্রমণ। মনের ভেতর হাজারো কল্পনা-জল্পনা আর চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে। কত দেশ ও দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে গন্তব্য স্থান জেদ্দা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। ইমগ্রেশনের মুখোমুখি দ্রুত পাস নিয়ে বের হয়ে গেলাম। তারপর বিদেশ ভ্রমণে কিছু উপলদ্ধি আর অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণনা। বিগত ১৪-০২-২০২২ তারিখ থেকে ১১-০৫-২০২২ তারিখ (অর্থাৎ ৩ মাস) পর্যন্ত।
ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ও বিখ্যাত স্থাপনা আছে। সৌদি আরব ভ্রমণ পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে সবসময়ই কাঙ্ক্ষিত। সবই যেন নান্দনিকতার অপূর্ব নিদর্শন। সৌদি আরবের বেশির ভাগ জায়গা মরুভূমি ও পাথরের পাহাড় বেষ্টিত। মক্কা-মদিনা, জেদ্দা- তায়েফের নিদর্শনীয় স্থান গুলো একনজরে।
মক্কা শরীফঃ- মুসলমানেরা ওমরা ও হজ পালন করতে সৌদি আরবে যান। ওমরা-হজের পাশাপাশি মক্কা ও মদিনার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা। সৌদি আরবের ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পন্ন ও সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থাপনার পাশাপাশি শপিংমল, হোটেল, প্রাচীন ও ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ছড়িয়ে আছে ।
হাজরে আসওয়াদ বা কালাে পাথর-হাজরে আসওয়াদ কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্বকোণে মাতাফ (তাওয়াফের জায়গা) থেকে দেড় মিটার ওপরে লাগানাে। হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফ (কাবা শরিফ সাতবার চক্কর দেওয়া) শুরুর স্থান।
মাকামে ইব্রাহিম-কাবা শরিফের পাশেই আছে ক্রিস্টালের একটা বাক্স,চারদিকে লােহার বেষ্টনী। ভেতরে বর্গাকৃতির একটি পাথর। পাথরটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান-প্রায় এক হাত। এই পাথরটিই মাকামে ইব্রাহিম।
কাবার গিলাফ-আরবরা কাবাকে আবৃত করে রাখা কাপড়টিকে বলে কিসওয়া। আর আমরা বলি গিলাফ। হজের কয়েক দিন আগে থেকেই কাবা শরিফের গিলাফের নিচু অংশ ওপরের দিকে তুলে দেওয়া হয়। এতে কাবা শরিফের দেয়ালের বাইরের অংশ দেখা ও ধরা যায়।
কাবাঘর-কাবাঘর প্রায় বর্গাকৃতির। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে আনুমানিক ৪৫ ও ৪০ ফুট। কাবা শরিফের দরজা একটি এবং দরজাটি কাবাঘরের পূর্ব দিকে অবস্থিত।
মিযাবে রহমত-বায়তুল্লাহর উত্তর দিকের ছাদে (হাতিমের মাঝ বরাবর) যে নালা বসানো আছে, তাকে ‘মিযাবে রহমত’ বলা হয়। এই নালা দিয়ে ছাদের বৃষ্টির পানি পড়ে। হাতিম-কাবাঘরের উত্তর দিকে অর্ধবৃত্তাকার উঁচু প্রাচীরে ঘেরা একটি স্থান।
জমজম কূপ-দুনিয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যত অনুপম নিদর্শন আছে, এর মধ্যে মক্কা শরিফে অবস্থিত ‘জমজম কূপ’ অন্যতম। জমজম কূপের ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। এ কূপের পানি সর্বাধিক স্বচ্ছ, উৎকৃষ্ট, পবিত্র ও বরকতময়। এ পানি শুধু পিপাসাই মেটায় না; এতে ক্ষুধাও নিবৃত্ত হয়। মসজিদ আল হারামের পেছনেই রয়েছে মক্কা ক্লক রয়েল টাওয়ার। এটি বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ উচ্চতার বহুতল ভবন।
জাবালে নূর বা হেরা পর্বত-মক্কার হারাম এলাকার কাছে জাবালে নূর বা হেরা পর্বত অবস্থিত। এই পর্বতে ওঠা-নামা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়।
আরাফাত ময়দানের ইতিহাস: আরাফাত ময়দান। একটি ইতিহাস, একটি মর্যাদাপূর্ণ ময়দান। আরাফাত ময়দানের ইতিহাস হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) এর সঙ্গে জড়িত। আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) মহান আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত থেকে বের হওয়ার পর পৃথিবীতে সর্বপ্রথম তাদের পরস্পর সাক্ষাৎ এই আরাফাত ময়দানে হয়। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এ ময়দানেই দিয়েছেন বিদায় হজের ভাষণ।
আল মদিনাতুল মুনাওয়ারা যেটি পশ্চিমা সৌদি আরবের হেজাজ অঞ্চলের একটি শহর।
মসজিদে নববী –মহানবী (স) মদিনা শহরে আগমনের পরে ব্যক্তিগত ভাবে এই মসজিদের নির্মাণ কাজে অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালের মুসলিম শাসকেরা মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্য্য বর্ধন করিছেন। বর্তমানে মসজিদে নববির অভ্যন্তরে হজরত আয়েশা (রা) যে ঘর, সেই ঘরে প্রিয় নবি (সা)কে দাফন করানো হয়েছে।
জান্নাতুল বাকি –মদিনার মসজিদে নববির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এই স্থানটি অবস্থিত। এখানে প্রিয় নবীর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, হজরত ওসমান সহ সাহাবায় কেরামদের অনেক কেই দাফন করা হয়েছে বলে জানা যায়।
মসজিদে কুবা – মসজিদে কুবা হচ্ছে ইসলামের প্রথম মসজিদ। নবী সাঃ মদিনায় আগমনের পরে সর্বপ্রথম এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মসজিদ আল কিবলাতাইন – ঐতিহাসিক দিক থেকে এই মসজিদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে নামাজ পড়ার সময় মুহাম্মদ সাঃ এর কাছে কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশের জন্য ওহি এসেছিল।
হুদ পাহাড় –মদিনা শহরের উত্তরে ১০৭৭ মিটার তথা ৩৫৩৩ ফুট উচ্চতার এই হুদ পাহাড়টি অবস্থিত। এ পাহাড়ের পাদদেশে মক্কার কুরাইশ ও মদিনার মুসলিমদের মধ্যে দ্বিতীয় যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ ৭০ জন সাহাবি শাহাদাত বরণ করেন।
জেদ্দা সমুদ্র সৈকতেঃ-লোহিত সাগর নাম হলেও সীমাহীন জলরাশি দেখতে নীল। মনোরম দৃশ্য দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন এখানে, ছবি তোলেন, পাড়ে বসে আড্ডা দেন। সাগরের তীরে বেড়ে ওঠা সারি সারি নারকেল, খেজুর আর বাহারী ফুলের সঙ্গে সবুজ ঘাসের সংমিশ্রণ দেখে কেউ মনে করবে না এটা মরুভূমির দেশ। জেদ্দা সমুদ্র সৈকতে একটু অবসর পেলেই দলবেঁধে স্বপরিবারে প্রবাসীরা ছুটে আসেন। প্রবাসী ছাড়াও এখানে সৌদি নাগরিকদের আগমন চোখে পড়ার মতো।
সৌন্দর্যের লীলাভূমি তায়েফঃ- ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি তায়েফ। চমৎকার সাজানো গোছানো শহর। মক্কা থেকে তায়েফের রাস্তাগুলো পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি করা। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে শরীর হিম করা গভীর খাদ। অবাক করা বিচিত্র রঙের পাথর দিয়ে কে যেন পাহাড় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সেই সব অনিন্দ্য সুন্দর পাহাড়ের পাদদেশ কেটে তৈরি হয়েছে দুই লেন বিশিষ্ট রাস্তা। একটি উপরে উঠার- অন্যটি নামার। পাথরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখছি আর উপরে উঠছি। অনেক উপরে ওঠার প্রতিক্রিয়ায় গাড়ির ভেতরে নিঃশ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হওয়ার পাশাপাশি, কান বন্ধ হয়ে যায় আপনা-আপনি। তায়েফের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায়, ঝকঝকে নীল আকাশ। মরুর দেশে এমন নীল আকাশের কথা চিন্তা করা যায়? পাহাড় দেখে মানুষ কেন আপ্লুত হয়, সেটা তায়েফের পাহাড় না দেখলে জানতাম না। খুব বেশি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই। তারপরও আমার মনে হয়, পাহাড়ের সৌন্দর্য আর আকাশের সত্যিকারের নীল দেখতে হলে তায়েফের আকাশ দেখতে হবে।
রক্তের বাঁধনঃ- আমার পরিবার সৌদি আরবে বসবাস করে। আমাদের পরিবারে ৯ ভাই ও ৩ বোন। আলহামদুলিল্লাহ বাবা-মা এখনো জীবিত। ৮ ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। বোনদের বিয়ে দিয়েছি। ৬ ভাই-৩ বোন ও বাবা-মা সবাই প্রবাসী। পরিবারের সবাই কে এক সাথে দেখা হয় না দীর্ঘ সময় ধরে। কেউ দেশে কেউ বিদেশে যাওয়া আসা সবার হয়ে মাঝে মাঝে। শুধু আমি একজন যায় নি সৌদি আরবে। ইতিমধ্যে আমরা বিয়ে করে যা যার পরিবার নিয়ে নিজেদের মত ব্যস্ত। কিন্তু কোন ভাই যখন অভাবে থাকে বা কোন একজনের অর্থ-বুদ্ধি-শক্তি প্রয়োজন পড়ে তখন আমরা একত্রিত হয়ে সমস্যার সমাধান করি। কখনো কখনো এমন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত -অপ্রাপ্তিও অপ্রত্যাশিত ঘটনা আমাদের মাঝে ঘটে যা আনন্দ উল্লাসের উৎসব হয়। উদাহরণ স্বরূপ আমি দেশে আমার মতো চলি। হঠাৎ অপরিকল্পিত ভাবে ভাইদের সিদ্ধান্ত আমাকে সৌদি আরব ভ্রমন করাবে। কে জানতো এমন করে হবে। ভাইদের কি দরকার আমাকে মক্কা-মদিনা দেখানোর! আচমকা ভাইয়েরা আমাকে জোর করে পাসপোর্ট জমা দিতে বলে। আমি বিস্মিত হয়ে মজা করেছি। অবিশ্বাস্য ভাবে আমার জন্য ট্যুরিস ভিসা পাঠিয়ে দ্রুত ভিসা লাগানো ব্যবস্থা করতে বলল। আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি, আমার টাকা নেই। ভিসা লাগানো আমার পক্ষে সম্ভব নই। কিন্তু কোন প্রশ্ন না করে অধমের ভাই গুলো বলল তোর টাকার চিন্তা করতে হবে না। ওমুক কে পাসপোর্ট দিয়ে দাও আর ব্যাগ ঘুচিয়ে নাও। পাসপোর্ট দিলাম কয় দিন পর ভিসা লাগিয়ে আমার কাছে পাসপোর্ট বিমান টিকেট সহ বুঝিয়ে দিয়ে গেল। তখন চিন্তা করেছি হয়তো তাদের কোন প্রয়োজনে আমাকে নিচ্ছে। আমি যখন সৌদি আরবে পৌঁছে তাদের দ্বারস্থ হলাম। তথা বুঝতে আর দেরী হচ্ছে না। ভাই গুলো মিলে আমার যাতায়াত খরচ তারা নিজেরাই আমার পেছনে ব্যয় করেছে। সত্যিই আমি অভিভূত প্রায় এবং আবেগ আপ্লুত। এমন ভাই পাওয়া জীবনে বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার।
বিদায় বেলাঃ- বিদায় যেহেতু সবচেয়ে কষ্টের, সবচেয়ে বিষাদের তাই জীবনের অন্যান্য বিদায়ের সময় শেষ বিদায়ের কথা স্মরণ করতে হবে। ভাইদের বিদায় কখনো চির বিদায় হতে পারে না। কাজেই আমার ভাইদের প্রাণপন চেষ্টা আর সাধ্য মত আমাকে খুশি করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। আলহামদুলিল্লাহ আমি ও ভাইদের সহযোগিতা ও সাহায্যে যা দেখেছি এবং পেয়েছি তাতে ভীষণ আনন্দিত। দু’টি কবিতার লাইন না দিলে নই। তাই দিলাম;
“বিদায় কেবলমাত্র তাদের জন্য যারা তাদের চোখের দেখা ভালোবাসেন।
যারা হৃদয় ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন তাদের জন্য বিদায়ের মতো কোন জিনিস নেই ।”